লেবাননে অব্যাহত ইসরাইলী হামলা
লেবাননের দক্ষিণ বৈরুতের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১২টি বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইলী সামরিক বাহিনী। গতকাল শনিবার সকালেও হামলা অব্যাহত ছিল। এ নিয়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে লেবাননজুড়ে ইসরাইলী হামলায় নিহতের সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে ২৬১ জন নারী ও ১২৭টি শিশু রয়েছে বলে জানিয়েছে লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আল জাজিরা, এপি, বিবিসি, রয়টার্স।
শুক্রবারও বৈরুতে একের পর এক প্রচ- বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। বিশেষ করে দক্ষিণ শহরতলিতে যা দহিয়েহ নামে পরিচিত। ওই এলাকায় হামাস ও হিজবুল্লাহ স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে ইসরাইলী সেনারা। এলাকাটি খ্রিষ্টান এলাকা আচরাফিহ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরত্বে। ফলে ওইসব এলাকা ছেড়ে অন্যত্র বা শহরের অন্যপাশে আশ্রয় নিচ্ছেন মানুষ। ফলে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত এখন অস্থায়ী তাঁবুতে পরিণত হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, বৈরুত এখন একটি যুদ্ধক্ষেত্র। আমরা বিশ্বাস করতে চাই বা না চাই-এটি এখন গাজার মতোই এক যুদ্ধক্ষেত্র। হামলার মুখে লেবাননে ১২ লাখের বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার। অব্যাহত বিমান হামলার মুখে রাজধানী বৈরুতের হাজারো বেসামরিক মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাড়িঘর ছেড়েছেন।
ইসরাইল দাবি করছে যে, তারা হিজবুল্লাহর স্থাপনাগুলোতে হামলা চালাচ্ছে। কিন্তু প্রাণ হারাচ্ছে বেসামরিক নাগরিক। এছাড়া হামলার মুখে লেবাননে ১২ লাখের বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার। অব্যাহত বিমান হামলার মুখে রাজধানী বৈরুতের হাজারো বেসামরিক মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাড়িঘর ছেড়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে, উত্তর ইসরাইলে বিমান হামলার সতর্কতাগুলো অব্যাহত রয়েছে।
দক্ষিণ লেবাননে মসজিদে ইসরাইলী হামলা : ইসরাইলী সামরিক বাহিনী দক্ষিণ লেবাননের একটি হাসপাতাল সংলগ্ন মসজিদে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। সম্প্রতি ইসরাইল লেবাননের বেসামরিক স্থাপনায় হামলার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সালাহ গান্দুর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই হামলায় চিকিৎসাকর্মীরা আহত হয়েছে। আহতদের অধিকাংশের অবস্থাই গুরুতর।
অবশ্য ইসরাইলী সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা ওই মসজিদে অবস্থান করছিল জেনেই তারা হামলা চালিয়েছে। লেবাননের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, বিনত জিবেলি শহরের ওই হাসপাতাল লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক জানিয়েছে, সরাসরি হাসপাতালটিতে হামলা চালানো হয়। অনেককেই উদ্ধার করা হয়েছে। অন্যদিকে লেবাননের উত্তরাঞ্চলীয় শহর ত্রিপোলিতে প্রথমবারের মতো হামলা চালিয়েছে ইসরাইলী বাহিনী। লেবাননের একটি নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে বৈরুতের শহরতলিতে আরও বোমা হামলার পর ইসরাইলী সেনারা দক্ষিণ লেবাননে নতুন স্থলে অনুপ্রবেশ করতে চেয়েছিল।
ইরাকি ড্রোন হামলায় ২৬ ইসরাইলী সেনা হতাহত : ইরাক থেকে পরিচালিত ড্রোন হামলায় ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলে অন্তত ২৬ সেনা হতাহত হয়েছে। এর মধ্যে দুজ’ন সেনা নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও অন্তত ২৪ জন। আহতদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা গুরুতর, একজন মাঝারি ধরনের আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। এছাড়া বাকি সেনারা সামান্য আহত হয়েছে বলে ইসরাইলী সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। শুক্রবার ইসরাইলী সামরিক কর্মকর্তারা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বলে প্রতিবেদেন উল্লেখ করা হয়।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সকালে ড্রোন হামলা চালায় ইরাকি প্রতিরোধ গোষ্ঠী ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স। ফিলিস্তিনীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশে গত এক বছরে বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে তারা। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এবারই প্রথমবারের মতো ইরাকের ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স এমন বড় ধরনের সেনা হতাহতের ঘটনা ঘটিয়েছে। নিহত ইসরাইলী সেনার সংখ্যাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ ১৯৭৩ সালের পর এই প্রথম কোনও ইরাকি হামলায় ইসরাইলী সেনা নিহত হয়েছে। ওই হামলায় অধিকৃত গোলান মালভূমির একটি ঘাঁটিতে থাকা অবস্থায় ইসরাইলী সামরিক বাহিনীর গোলানি ব্রিগেডের দুই সদস্য নিহত হন। ইসরাইলী কর্মকর্তারা প্রথমে বলেছিলেন, ওই দুই সেনা ‘যুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। পরে জানানো হয়, তারা হামলার ফলে প্রাণ হারিয়েছে।
ইসরাইলী সামরিক স্থাপনায় হিজবুল্লাহর ৭টি হামলা : লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠীটি শনিবার টেলিগ্রামে এক বিবৃতিতে জানায়, তারা উত্তর ইসরাইলের হাইফা শহরের কাছে রামাত ডেভিড বিমানঘাঁটিতে ফাদি-১ রকেট নিক্ষেপ করেছে। ইসরাইলের এই স্থাপনাটি লেবানন সীমান্ত থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ হামলার ফলে ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে বিশেষ করে নাজারেথসহ বেশ কিছু শহরে সতর্কতামূলক সাইরেন বেজে ওঠে। হিজবুল্লাহ আরও জানায়, তাদের যোদ্ধারা একটি ইসরাইলী মেরকাভা ট্যাংককে গাইডেড অ্যান্টি-আর্মার ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তু করেছে। যার ফলে বেশ কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
ইসরাইলী সেনাদের পিছু হটতে বাধ্য করল হিজবুল্লাহ : লেবাননে প্রবেশ করতে গত তিন-চারদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে দখলদার ইসরাইলের সেনারা। শনিবার (৫ অক্টোবর) মধ্যরাতে আদাইসেহ নামের একটি সীমান্তবর্তী গ্রাম দিয়ে আবারও এই চেষ্টা চালিয়েছিল তারা। তবে হিজবুল্লাহর প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে ইসরাইলী সেনারা। হিজবুল্লাহর বরাতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, আদাইসেহ গ্রামে ইসরাইলী সেনাদের সঙ্গে হিজবুল্লাহর যোদ্ধাদের তীব্র লড়াই হয়। ওই সময় ইসরাইলী সেনারা পিছু হটে। যেসব সেনা লেবাননে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন তাদের মধ্যে বেশ কয়েককজন হতাহত হয়েছেন।
আদাইসেহ গ্রামের লড়াই নিয়ে দখলদার ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বিবিসি। তবে এ ব্যাপারে তারা কোনো তথ্য জানাতে রাজি হয়নি। এমনকি অভিযানে গিয়ে কত সেনা হতাহত হয়েছে সে ব্যাপারেও মুখ খোলেনি আইডিএফ। গত দুই সপ্তাহ ধরে গাজার যুদ্ধ অনেকটাই লেবাননের দিকে চলে গেছে। এই সময়ের মধ্যে হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহসহ অনেক উচ্চপদস্থ কমান্ডারকে হত্যা করেছে দখলদার ইসরাইল। এছাড়া পেজার এবং ওয়াকিটকিতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হিজবুল্লাহর কয়েক হাজার যোদ্ধাকে আহত করেছে।
ধারণা করা হয়েছিল, এসব হামলার জেরে হিজবুল্লাহ সীমান্তে ইসরাইলী বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়তে পারবে না। তবে ইসরাইলী সেনারা স্থল হামলা চালাতে যখন লেবাননে প্রবেশের চেষ্টা চালানো শুরু করে তখনই হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা তাদের লক্ষ্য করে গুপ্ত হামলা শুরু করে। এতে করে স্থল হামলার প্রথমদিনই ইসরাইলের চৌকস ব্রিগেডের আট সেনা নিহত হয়।
ইসরাইলের সব জ্বালানি স্থাপনা একসঙ্গে ধ্বংসের হুঁশিয়ারি আইআরজিসি’র
ইরানে নতুন করে যেকোনো ধরনের আগ্রাসন চালানোর চেষ্টা করলে ইসরাইলের সব জ্বালানি স্থাপনা একসঙ্গে ধ্বংস করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে দেশটির ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)। গত শুক্রবার লেবাননের আল-মায়াদিন টিভি চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ হুঁশিয়ারি দেন আইআরজিসি’র ডেপুটি কমান্ডার মেজর জেনারেল আলী ফাদাভি। তিনি বলেন, ইরানে হামলা চালালে নিজের অস্তিত্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে ইসরাইল।
তিনি আরও বলেন, দখলদার সরকার যদি কোনো ভুল করে তাহলে আমরা এটির জ্বালানির সকল উৎস, সবগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, সব তেল শোধনাগার ও গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে একযোগে হামলা চালাব। ফিলিস্তিন ও লেবাননে ইহুদিবাদী সেনাদের ভয়ঙ্কর সব অপরাধের শাস্তি দিতে গত মঙ্গলবার রাতে ইরান ইসরাইলের সামরিক স্থাপনাগুলোতে বড় ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পর তেল আবিব ইরানের তেল ক্ষেত্রগুলোতে হামলা চালানোর হুমকি দেয়। ওই হুমকির প্রেক্ষাপটে জেনারেল ফাদাভি পাল্টা এ হুঁশিয়ারি দিলেন। তিনি বলেন, ইরান একটি বিশাল দেশ যার রয়েছে বহুমুখী অর্থনৈতিক কেন্দ্র, অথচ ইসরাইলের মাত্র তিনটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও কয়েকটি শোধনাগার রয়েছে। জেনারেল ফাদাভি বলেন, ওইসব কেন্দ্রে একযোগে হামলা চালানোর সক্ষমতা আমাদের রয়েছে।
এদিকে ইরানের সেনাবাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল আব্দুর রহিম মুসাভি শুক্রবার (৪ অক্টোবর) আল-মায়াদিনকে বলেছেন, ইহুদিবাদী ইসরাইল যদি কোনো কাঁচা কাজ করে তাহলে তাকে ‘ভয়ানক ও ধ্বংসাত্মক জবাব’ দেয়া হবে।
তিনি বলেন, আমরা অতীতে ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছি, কিন্তু এখন আমরা উপযুক্ত সময়ে নিখুঁত ও ধ্বংসাত্মক জবাব দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছি। জেনারেল মুসাভি বলেন, ইসরাইল যেকোনো পর্যায়ে যতখানি আগ্রাসন চালাবে তেহরান তার চেয়ে শক্তিশালী জবাব দেবে।
ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মুখে বাড়ি ছেড়ে পালালেন নেতানিয়াহু : লেবাননভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মুখে নিজ বাসভবন ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সাম্প্রতিক হামলায় আলখাদ্বিরা অঞ্চলের উত্তরে কাইসারিয়া এলাকায় অবস্থিত নিজ বাসভবন ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেন তিনি। ইসরাইলী সংবাদমাধ্যম ওয়ালার বরাত দিয়ে এমনটা দাবি করেছেন সংবাদমাধ্যম আল মায়াদিন। এর আগে ইরানী হামলা থেকে বাঁচতে পালাচ্ছেন নেতানিয়াহু এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। পরে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা ফ্যাক্টচেকে বেরিয়ে আসে যে ভিডিও ২০২১ সালের। পার্লামেন্টে দৌড়ে ঢুকছেন নেতানিয়াহু, কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে নয়। তবে হিজবুল্লাহর হামলার প্রেক্ষিতে তার যে পালিয়ে যাওয়ার দাবি করা হচ্ছে সে বিষয়ে এখনো স্পষ্ট করে কিছু জানা যায়নি।